সোমবার , ২০শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ || ৬ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
তাবারক হোসেন আজাদ, লক্ষ্মীপুর::
আঁই আগে স্কুলে যাইতাম। এক বছর হইছে, স্কুলে আর যাই না। এহন নদীতে আব্বার লগে মাছ ধরতে যাই। আঁর খুব ইচ্ছা, লেয়াহড়া করতাম।
আঁর মতন অনেকগুন হোলা-মাইয়া স্কুলে আহেনা। হেগুনরাও অনেক কাম করে। অন্য স্কুলের হোলাহাইনে টেয়া (উপবৃত্তি) হায়। আঙ্গোরে টেয়া (উপবৃত্তি) দেয়না । এহন আর আঙ্গোরে স্কুলের স্যার ও ম্যাডামরাও ঢাহেনা। স্কুল কি আর খুলবো না-? আঙ্গোরে কি নতুন বই দিবোনা-? যদি আবার চালু হয়, আন্ডা বেজ্ঞুন স্কুলে আইয়াম। টিউনো (ইউএনও) স্যাররে কন আঙ্গো স্কুলকান সুন্দর করি দিতো।
বুধবার সকালে (২৫ ডিসেম্বর) লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার দক্ষিন চরবংশী ইউপির চরকাচিয়া আশ্রয়কেন্দ্র বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গেলে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ পাওয়া যায়। স্কুলটির পাশে নদীর পাড়ে দেখা হয় চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র আবিরের সঙ্গে। সে একথা বলেন।
আর ৫দিন পরই নতুন বছরের প্রথম দিন সারা দেশের ন্যায় রায়পুরেও বই উৎসব হবে। তবে- এই উৎসব থেকে বঞ্চিত হবে জেলে অধ্যাষিত আশ্রয়নকেন্দ্রে বসবাসকারী ১২০ জেলে পরিবার শিশুদের জন্য নির্মিত স্কুল শিক্ষার্থীরা।
খোঁজ নিয়ে জানাযায়, ২০১১ সালের ১ জুলাই রায়পুরের মেঘনা নদীর পাড়ে আশ্রয়কেন্দ্র ও আবাসনকেন্দ্রে বসবাসকারী ১২০ পরিবারের শিশুদের জন্য নির্মাণ করা হয় চরকাচিয়া আশ্রয়কেন্দ্র বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই স্কুলের দুই কিলোমিটারে একটি কেজি স্কুল ছাড়া সরকারি কোন প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি।
লক্ষ্মীপুরের সাবেক জেলা প্রশাসক জিল্লুর রহমানের নির্দেশে রায়পুরের সাবেক ইউএনও শারমিন আলম মেঘনার পাড়ে সরকারি খাস জমির ৪ শতাংশ খালি জায়গায় ওই স্কুলটি নির্মাণ করে দিয়েছেন। এতে চারটি কক্ষ, দুটি টয়লেটেও রয়েছে। স্কুলের প্রধান শিক্ষক মোঃ চাঁন মিয়া, সহকারি শিক্ষক ফাতেমা বেগম, খালেদা খানম, ঝুমুর রানী দে, আসমা আক্তার, ও তানিয়া বেগম প্রথম থেকে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত ১৩০ জন শিক্ষার্থীদের পাঠদান করান।
উপজেলা প্রশাসনের ফান্ড থেকে কয়েকমাস শিক্ষকদের বেতন দেয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটি সরকারি হওয়ার আশায় থাকলেও তা আর না হওয়ায় শিক্ষকদের বেতন জোটেনি আজও। এতে মানবেতর জীবন যাপন করছেন তাঁরা।।
সরকারিকরনে শর্তপূরণের অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠানের নামে জমি বরাদ্দ, অবকাঠামো, শিক্ষক নিয়োগ, ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি, আসবাবপত্র ও নিয়মিত পাঠদান প্রক্রিয়া চালু থাকলেও দীর্ঘদিন থেকে বিনা পারিশ্রমিকে শ্রম দিতে হচ্ছিলো এখানকার শিক্ষকদের। অবশেষে নিরুপায় হয়ে ২০২৩ সালে স্কুলটি বন্ধ করে দেয়া হয়। কেউ কেউ মুদি দোকান, টিউশনি করে বা বিকল্প উপায়ে সংসার চালাচ্ছেন।
প্রাথমিক শিক্ষা অফিস জানায়, উপজেলায় ১২১টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৮০টি কেজি স্কুল, ১টি সরকারিসহ ৬টি বেসরকারি কলেজ, এমপিওভুক্ত ৫১টি মাধ্যমিক প্রতিষ্ঠান (১৮ মাদরাসা ও ৩৩টি উচ্চ বিদ্যালয়) রয়েছে। এর মধ্যে বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পূর্ণাঙ্গভাবে, কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিম্নমাধ্যমিক থেকে উচ্চ স্তর, কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে কলেজে উন্নীত করে এমপিওভুক্তি এবং কিছু প্রাথমিক সরকারিকরনের অপেক্ষায়।
চরকাচিয়া আশ্রায়ন প্রকল্পের বাসিন্দা মাইনুদ্দিন মাঝি, হাফিজুল্লাহ মাঝি ও গৃহবধু ছালমা বেগম বলেন, সাবেক জেলা প্রশাসক অনেক ভাল মনের মানুষ ছিলেন। প্রায় সময় চরে আমাদের অসহায় দিনমজুর ও জেলে পরিবারদের দেখতে আসতেন। আমাদের সন্তানরা ভালো লেখাপড়া করবে ও উচ্চ শিক্ষিত হবে এইভেবে স্কুলটি নির্মাণ করেন। বই ছাড়া শিশুদের উপবৃত্তি দেয়া হয়না। শিক্ষকদের বেতন নাই। সন্তানদেরকে কিন্ডারগার্টেনও পড়াশোনা করাতে পারছি না। দূরের কোন প্রতিষ্ঠানে পাঠাতে সাহস পাইনা। ছেলেমেয়েরা মেধা শূন্য হয়ে যাচ্ছে। কেউ নদীতে মাছ ধরতে নদীতে, কেউ মাদকাসক্ত, কেউ জুয়া ও কেউ চুরি করার মত নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। আশ্রায়ন প্রকল্পের একটা স্কুল আছে বর্তমান ইউএনও মনে হয় জানেনই না। কারণ পূর্বের স্যারেরা ১-২ মাস পরে আমাদেরকে দেখতে আসতেন। স্কুলটিও দেখে যেতেন এবং খোঁজ খবর নিতেন।
চরকাচিয়া আশ্রয়কেন্দ্র প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষক চাঁন মিয়া বলেন, ‘স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করা হয় মেঘনার পাড়ে অসহায়- নিরীহ জেলে ও দিমজুর পরিবারের শিশুদের সু-শিক্ষার জন্য। সাবেক ইউএনওরা শিক্ষকদেরকে কিছু সম্মানী ভাতাও দিয়েছিলেন। বর্তমান ইউএনও শিক্ষকদের মোট ১৩ হাজার টাকা করে ৩ মাসের বেতনও দিয়েছেন। এখন আর বেতন দেয়া হবেনা বলে জানিয়ে দেন। বেতন না পেয়ে চাকরি করছি বলে নিজেকে অন্যের কাছে উপস্থাপন করা লজ্জার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রায়পুর শিক্ষাকর্মকর্তা মইনুল ইসলাম বলেন, শুধু মেঘনার পাড়ে চরকাচিয়া বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ই না সব বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য শুধু বই বিতরন ছাড়া অন্য কোন সুযোগ সুবিধা দেয়া হয়না। ইউএনওর সাথে কথা বলে দেখেন।
রায়পুর উপজেলা নির্বার্হী কর্মকর্তা (ইউএনও) স্কুলটির সভাপতি ইমরান খাঁন বলেন-নানা ব্যাস্ততার কারনে স্কুলটির খোঁজ নেয়া হয়না। সহসায় স্কুলটি পরিদর্শন করবো।