শনিবার , ২৪শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ || ১০ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
মাওলানা মোঃ মামুনুর রশীদ আল কাফিঃ
* ভূমিকা-পৃথিবীর সূচনালগ্ন থেকেই আকলসম্পন্ন মাখলুকের মধ্যে ভালবাসা এক চিরন্তন নিয়ম। যা মহান আল্লাহ তা’য়ালার এক বিশেষ নিয়ামত। এর মাধ্যমে মানুষের সুপ্ত হৃদয়ের সুকুমারবৃত্তি বিকশিত হয়। মানুষ নতুন করে ভাবতে শিখে, তার ভিতরে অনুভূতি জাগে। সাধারণতঃ ভালবাসার মাধ্যমে মানুষ পূণ্য ও পাপ দুটিই অর্জন করে থাকে। নিম্নে কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোকপাত করা হলো।
ভালবাসার পরিচয়
* আভিধানিক অর্থ– ভালবাসা শব্দের আভিধানিক অর্থ- বন্ধুত্ব স্থাপন করা, আপন করা, হৃদয়ের টান, অন্তরের ঝোঁক, মনের মনিকোঠায় স্থান করা, অন্তরের আকর্ষন ইত্যাদি। যাকে আরবি ভাষায় মুহাব্বাত বলা হয়।
** পরিভাষায়- কোন ব্যক্তি বা বস্তুর মধ্যে পরিপূর্ণ গুণাবলী থাকার কারণে তার প্রতি আন্তরিকভাবে আকৃষ্ট হওয়াকে ভালবাসা বলে।
প্রকারভেদ
* কুরআন সুন্নাহর আলোকে প্রথমত ভালবাসা দু’ভাগে বিভক্ত। যথা-
১। আল্লাহর প্রতি বান্দাহর ভালবাসাঃ
এর অর্থ হলো- আল্লাহর আনুগত্য ও ইবাদতের ইচ্ছা পোষণ করা। যেমন- আল্লাহ তা’য়ালা বলেন- যারা মুমিন তারা আল্লাহকে সবচাইতে বেশি ভালবাসে। (সুরা বাকারা-১৬৫)
২। বান্দাহর প্রতি আল্লাহর ভালবাসাঃ এর অর্থ হলো- বান্দাহর কাজের প্রতি আল্লাহর সন্তুষ্টি থাকা। যেমন- হাদিসে কুদসীতে আল্লাহ তা’য়ালা বলেন-আমার বান্দাহ নফল ইবাদতের মাধ্যমে আমার নিকটবর্তী হয়। অবশেষে আমি তাকে ভালবাসি। যখন আমি তাকে ভালবেসে ফেলি, তখন আমি তার কান হয়ে যাই যা দ্বারা সে শুনে, আমি তার চক্ষু হয়ে যাই যা দ্বারা সে দেখে, আমি তার হাত হয়ে যাই যা দ্বারা সে ধরে, তার পা আমার কুদরতি শক্তিতে শক্তিমান হয়ে যায় যা দ্বারা সে চলে। এমতাবস্থায়, সে যদি আমার কাছে কিছু চায় আমি অবশ্যই তাকে দান করি। আমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করলে আমি আশ্রয় দান করি। (সহীহ বুখারী)
১। ইমানি ভালবাসা-আল্লাহ ও রাসুল সা. এর উপর ইমান আনয়নের কারণে মুমিনের অন্তরে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি, ইসলামি বিধি-বিধান এর প্রতি ও ইসলামের নিদর্শন সমূহের প্রতি যে আকর্ষণ সৃষ্টি হয়, তাকে ইমানি ভালবাসা বলে। এ সকল ভালবাসা মানুষকে সঠিক পথের সন্ধান দেয়, ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তির পথ সুগম করে। ইসলামি শরিয়তে এ ধরণের ভালবাসার বিধান ফরয।
যে ভালবাসা মানুষের জন্মগত ও স্বভাবজাত, যা মানুষের ক্ষমতা বর্হিভূত তাকে স্বভাবগত ভালবাসা বলে। যেমন- পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের এবং সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার ভালবাসা, স্বামী-স্ত্রীর প্রতি ভালবাসা ও সৃষ্টিজীবের সৌন্দর্যের প্রতি ভালবাসা ইত্যাদি।
৩। আকলগত ভালবাসা-স্বাভাবিক নয় তবে বিবেক বুদ্ধির কারণে মানুষের অন্তরে যে ভালবাসা সৃষ্টি হয়, তাকে আকলগত ভালবাসা বলে। যেমন-তিক্ত ঔষধ সেবনের প্রতি ভালবাসা।
১.ইমানি ভালবাসা ও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ভালবাসার ফযিলত-আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ভালবাসা স্থাপনকারীদের আল্লাহ ভালবাসেন- (ক) রাসুলুল্লাহ সা. বলেন- আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেন, যারা আমার সন্তুষ্টির জন্য পরস্পরকে ভালবাসে, আমাকে খুশি করার জন্য এক স্থানে মিলিত হয়ে আমার গুণগান করে, আমার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পরস্পর দেখা সাক্ষাত করে এবং আমার ভালবাসা অর্জনের জন্য নিজের সম্পদ পরস্পরের মধ্যে ব্যয় করে, তাদেরকে ভালবাসা আমার উপর ওয়াজিব।
(মুয়াত্তায়ে ইমাম মালেক)
(খ) আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ভালবাসা স্থাপনকারীর মর্যাদার স্বীকৃতি- আবু হোরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুল সা. ইরশাদ করেন- এক ব্যক্তি অন্য গ্রামে বসবাসকারী এক ভাইয়ের (বন্ধুর) সাথে স্বাক্ষাতের উদ্দেশ্যে বের হল। মহান আল্লাহ তার জন্য পথে একজন ফেরেস্তা মোতায়েন করে রাখেন, যখন সে ফেরেস্তা ঐ ব্যক্তির নিকটবর্তী হল, বলল তুমি কোথায় যাও? লোকটি বলল- এই গ্রামে বসবাসকারী আমার এক ভাইয়ের (বন্ধুর) সাথে সাক্ষাৎ করাই আমার উদ্দেশ্য। ফেরেস্তা বলল, তার কাছে তোমার কোন পাওনা আছে কি ? লোকটি বলল না। কিন্তু আমি তাকে আল্লাহর জন্য ভালবাসি। তখন ফেরেস্তা বলল, নিশ্চয়ই আমি তোমার নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত দুত। মহান আল্লাহ অবশ্যই তোমাকে ভালবেসেছেন, যে রকম তুমি তাকে আল্লাহর জন্য ভালবেসেছো। (সহীহ মুসলিম)
(গ) আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ভালবাসা স্থাপনকারী আরশের ছায়াতলে থাকবে- রাসুলুল্লাহ সা. বলেন- কিয়ামত দিবসে সাত ব্যক্তিকে আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর আরশের ছায়াতলে আশ্রয় দিবেন। যেদিন তার ছায়া ব্যতিত কোন ছায়া থাকবে না,
তারা হলেন-
১। ন্যায়পরায়ন শাসক।
২। ঐ যুবক, যার যৌবনকাল আল্লাহর ইবাদতে লালিত পালিত হয়েছে।
৩। ঐ ব্যক্তি, যার অন্তর মসজিদের সাথে ঝুলানো থাকে (মসজিদ থেকে বের হয়ে পুণরায় উহাতে প্রত্যাবর্তন করা পর্যন্ত)।
৪। ঐ দু’ব্যক্তি, যারা আল্লাহর জন্য পরস্পর পরস্পরের প্রতি ভালবাসা স্থাপন করেছে, তাঁর ভালবাসায় তারা একত্রিত হয়েছে এবং তাঁর ভালবাসায় তারা পৃথক হয়েছে।
৫। ঐ ব্যক্তি, যে নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে তার চক্ষু হতে অশ্রু প্রবাহিত হয়।
৬। ঐ ব্যক্তি, যাকে কোন সম্ভ্রান্ত মহিলা আহবান করে.. কিন্তু, সে বলে আমি আল্লাহকে ভয় করি।
৭। ঐ ব্যক্তি, যে গোপনে দান সদকা করে, এমনকি তার বাম হাত জানেনা ডান কি দান করে। (সহীহ বুখারী ও মুসলিম) অপর বর্ণণায় রাসুল সা. বলেন- আল্লাহ তা’য়ালা কিয়ামত দিবসে বলবেন, আমার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে পরস্পর ভালবাসা স্থাপনকারীরা কোথায়? আজ আমার ছায়া ব্যতিত কোন ছায়া থাকবেনা- আমি তাদেরকে আমার ছায়াতলে ছায়া দেব। (সহীহ মুসলিম)।
(ঘ) আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ভালবাসা জান্নাতে প্রবেশের বিশেষ মাধ্যম-রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, তোমরা ইমানদার না হওয়া পর্যন্ত জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না এবং পরস্পর ভালবাসা স্থাপন না করা পর্যন্ত ইমানদার হতে পারবেনা। (সহীহ মুসলিম)।
(ঙ) আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ভালবাসা স্থাপনকারীকে ফেরেস্তাগণ ভালবাসেন-রাসুলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন, যখন আল্লাহ তায়ালা কোন বান্দাহকে ভালবাসেন, তখন তিনি জিবরাইল আ. কে ডেকে বলেন, আমি অমুক ব্যক্তিকে ভালবাসি, তুমিও তাকে ভালবাসবে। রাসুল সা. বলেন-অতঃপর জিবরাইল আ. তাকে ভালবাসতে থাকেন এবং তিনি আসমানে ঘোষণা করেন যে, আল্লাহ তা’য়ালা অমুক ব্যক্তিকে ভালবাসেন, তোমরাও তাকে ভালবাস। অতঃপর যমীনেও সে বান্দাহর জন্য ভালবাসার কবুলিয়ত বা স্বীকৃতি স্থাপন করা হয়। (সহীহ মুসলিম)।
(চ) আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ভালবাসা স্থাপনকারীর জন্য নুরের মিনার থাকবে-রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেন, যারা আমার মহত্ব ও সম্মানের খাতিরে পরস্পর ভালবাসা স্থাপন করে তাদের জন্য জান্নাতে সুউচ্চ নুরের মিনার হবে, যা দেখে নবী ও শহীদগণ ঈর্ষা করবেন। (সুনানে তিরমিযি)।
(ছ) আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ভালবাসা ঈমানের মজবুত শাখা-একদিন রাসুল সা. আবু যার গিফারী রা. কে লক্ষ্য করে বলেন, হে আবু যার! ঈমানের কোন শাখাটি অধিক মজবুত? তিনি বললেন এ বিষয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলই অধিক জ্ঞাত। রাসুল সা. বলেন, তাহলো- একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পরস্পর বন্ধুত্ব স্থাপন করা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই কাউকে ভালবাসা ও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই কাউকে ঘৃণা করা। (সুনানে বায়হাকী)।
(জ) আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ভালবাসা ঈমান পূর্ণ করার মাধ্যম-রাসুলুল্লাহ সা. বলেন- যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে কাউকে ভালবাসে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যেই কাউকে দান করে বা নিষেধ করে, সে ব্যক্তি ইমানকে পরিপূর্ণ করল। (মিশকাতুল মাসাবীহ)
(ক) ইমানের পূর্ণতা লাভ হবে-আবদুল্লাহ ইবনে হিশাম রা. বর্ণনা করেন, আমরা নবী করিম সা. এর সাথে ছিলাম। তিনি তখন উমর ইবনে খাত্তাব রা. এর হাত ধরে ছিলেন। উমর রা. তাঁকে লক্ষ্য করে বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি আপনাকে সবকিছুর চেয়ে বেশী ভালবাসি, তবে আমার জীবনের চেয়ে বেশী নয়। আল্লাহর রাসূল সা. বললেন, ঐ সত্তার শপথ!যাঁর হাতে আমার প্রাণ, হে উমর! যতক্ষণ পর্যন্ত তোমার কাছে নিজের জীবনের চেয়েও আমি অধিক প্রিয় না হব, ততক্ষণ পর্যন্ত তুমি পরিপূর্ণ মু’মিন নও। একথা শুনে উমর রা. বললেন, আল্লাহর শপথ! এখন আমার জীবন থেকেও আমি আপনাকে বেশী ভালবাসি। তখন রাসুল সা. বললেন, হে উমর! এখন তুমি পরিপূর্ণ মু’মিন। (সহীহ বুখারী)
অপর বর্ণণায় আছে- রাসুল সা. বলেন সে মহান সত্তার শপথ! যার হাতে প্রাণ, তোমাদের কেউ প্রকৃত মুমিন হতে পারবেনা, যতক্ষণআমি তার নিকট তার পিতা-মাতা, সন্তান ও সকল মানুষের চেয়ে অধিক ভালবাসার পাত্র না হই। (সহীহ বুখারী)
(খ) আল্লাহর ভালবাসা পাওয়া যাবে-আল্লাহ তায়ালা বলেন-(হে রাসুল সা.) আপনি বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাসতে চাও, তাহলে তোমরা আমার অনুস্বরণ কর। এতে আল্লাহ তায়ালা তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদের সকল গোনাহ ক্ষমা করে দিবেন, আর আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান। (সূরা আলে ইমরান-৩১)
(গ) রাসুল সা. এর নৈকট্য লাভ-রাসুলুল্লাহ সা. বলেন- কিয়ামতের দিন আমার খুব কাছে থাকবে ঐ ব্যক্তি, যে আমার উপর অধিক পরিমাণে দুরুদ পড়বে (সুনানে তিরমিযি)
(ঘ) রাসুল সা. এর শাফায়াত লাভ-রাসুলুল্লাহ সা. বলেন-যে ব্যক্তি আমার রওযা যিয়ারত করবে তার জন্য আমার শাফায়াত ওয়াজিব হয়ে যাবে। (সুনানে বায়হাকি, দারেকুতনি)
অপর বর্ণণায় আছে- যে ব্যক্তি আমার ইন্তেকালের পর আমার রওযা যিয়ারত করবে, সে যেন আমার জীবদ্দশায় আমার সাথে সাক্ষাত করল। (তাবরানি, ম’ুজামুল আওসাত)
(ঙ) জান্নাতে রাসুল সা. এর সাথী হওয়া যাবে-আনাস বিন মালিক রা. বলেন- একদা এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসুল, কিয়ামত কখন হবে ? জবাবে রাসুল সা. বলেন-তোমার ধ্বংশ হোক! ঐ কিয়ামতের জন্য তুমি কী প্রস্তুতি নিয়েছ? লোকটি বলল- আমি তার জন্য কোন প্রস্তুতি নেইনি, তবে- আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে ভালবাসি। রাসুল সা. বলেন- তুমি যাকে ভালবাস কিয়ামত দিবসে তার সাথেই থাকবে। আনাস রা. বলেন-ইসলামের আবির্ভাবের পর মুসলমানদেরকে আমি কোন কথায় এতটা খুশি হতে দেখিনি, যতটা খুশি হয়েছিল তারা রাসুল সা. এর এই বাণীতে। (বুখারী ও মুসলিম)
অপর বর্ণনায় আছে রাসুল সা. বলেন- যে ব্যক্তি যাকে ভালবাসবে কিয়ামত দিবসে তার সাথেই থাকবে (মিশকাতুল মাসাবীহ)
রাসুল সা. আরও বলেন- যে ব্যক্তি যার সাথে সাদৃশ্য রাখবে হাশরের মাঠে সে তার সাথেই থাকবে। (সুনানে আবু দাউদ)
(চ) রাসূল সা. এর ভালবাসা পাওয়া যাবে-রাসুলুল্লাহ সা. বলেন- যে আমার সুন্নাতকে জীবিত করে সে যেন আমাকেই ভালবাসে। আর যে আমাকে ভালবাসল সে জান্নাতে আমার সাথেই থাকবে। (সুনানে তিরমিযি)
(ছ) ইমানের স্বাদ পাওয়া যাবে-রাসুলুল্লাহ সা. বলেন-তিনটি গুণ যার মধ্যে পাওয়া যাবে, সে ইমানের স্বাদ আস্বাদন করতে পারবে। (ক) আল্লাহ ও রাসূল সা. তার নিকট অন্য সকল কিছু হতে অধিক প্রিয় হওয়া (খ) কাউকে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই ভালবাসা (গ) কুফরিতে প্রত্যাবর্তনকে আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়ার মতো অপছন্দ করা। (সহীহ বুখারী-১৬)
আল্লাহ তা’য়ালা বলেন- যে ব্যক্তি আল্লাহর নিদর্শনসমূকে সম্মান করে, নিঃসন্দেহে এটা তার অন্তরের তাকওয়া।
(সুরা হজ্জ-৩২)
উক্ত আয়াতের তাফসীরে শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবি রহ. বলেন- আল্লাহর নিদর্শন প্রধাণতঃ ৪টি। যথা-
১। কিতাবুল্লাহ বা আল্লাহর কিতাব।
২। বাইতুল্লাহ বা আল্লাহর ঘর মাসজিদ।
৩। রাসুলুল্লাহ বা আল্লাহর রাসুল।
৪। ইবাদাতুল্লাহ বা আল্লাহর ইবাদতসমূহ।
১। আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আদেশসমূহ পালন করা।
২। তাঁদের নিষেধসমূহ বর্জন করা।
৩। আল্লাহর যিকির করা ও রাসুল সা. এর প্রতি দুরুদ পাঠ করা।
৪। আল্লাহর নিদর্শনসমূহকে সম্মান করা।
৫। যারা আল্লাহ ও রাসুলের কাছে প্রিয় তাদেরকে ভালবাসা।
৬। যারা আল্লাহ ও রাসুলের দুশমন তাদেরকে প্রত্যাখ্যান করা ইত্যাদি।
(ক) আল্লাহর প্রতি ভালবাসা-একবার ইবরাহীম আ. মাঠে অনেকগুলো বকরি চরাচ্ছিলেন। তখন একলোক সে পথে কোথাও যাচ্ছিল। গমনকালে লোকটি উঁচু আওয়াজে আল্লাহ তা’য়ালার শানে বলছিল-সুবহানাযিল মুলকি……. অর্থাৎ ‘‘তিনি সমগ্র ভূমন্ডল ও নভোমন্ডলের অধিপতি, অতিমহান ও পবিত্র। তিনি সম্মান, মর্যাদা, প্রভাব প্রতিপত্তি, কুদরত, বড়ত্ব ও মহত্ত্বের একচ্ছত্র অধিপতি মহান সত্তা।’’
লোকটি মুখে প্রিয় প্রেমাষ্পদের উচ্ছ্বাসিত প্রশংসা শুনে ইবরাহীম আ. এর হৃদয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হলো। তিনি লোকটির কাছে এগিয়ে গেলেন এবং তাকে অনুরোধের সুরে বললেন-ভাইজান! প্রশংসার বাক্যটির আরেকবার শোনাবেন ?
লোকটি বললঃ শোনালে কি দেবেন ?
ইবরাহীম আ. ঃ আমার সমস্ত বকরির অর্ধেক তোমাকে দিয়ে দিবো। লোকটি আল্লাহ তা’য়ালার প্রশংসামূলক বাক্যটি আরেকবার শোনাল। এতে ইবরাহীম আ. খুব মজা পেলেন এবং বললেন-ভাইজান! কথাগুলো আরেকবার শোনান।
লোকটি বলল- শোনালে আমাকে কি দেবেন ?
ইবরাহীম আ. ঃ বাকী অর্ধেক বকরির পাল দিয়ে দিবো। লোকটি আবার ঃ শোনাল। এতে ইবরাহীম আ. খুবই বিমোহিত হলেন এবং বললেন-ভাইজান! আপনার কথা গুলো আবার শোনান।
লোকটি বলল-আপনার তো দেওয়ার মতো আর বকরি নাই তাহলে আমাকে কি দেবেন ?
ইবরাহীম আ. বলল-আমি আপনার বকরির পালের রাখালগিরি করব। এবার লোকটি নিজের পরিচয় প্রকাশ করে বললেন- হে ইবরাহীম! আপনার প্রতি মোবারকবাদ। আমি জিবরাইল ফেরেস্তা। আল্লাহ তা’য়ালা আমাকে এ নির্দেশ দিয়ে পাঠিয়েছেন যে, যাও ইবরাহীমের সামনে আমার নাম উচ্চারণ কর আর দেখ সে আমার নামের কি মূল্য দেয়। সুবহানাল্লাহ। (ইশক্ েএলাহী-৩১)
(খ) রাসুলুল্লাহ সা. এর প্রতি ভালবাসা-উহুদ যুদ্ধে প্রাথমিকভাবে মুসলমানদের বিজয় হয়েছিল। কিন্তু রাসুল সা. এর একটি নির্দেশ অমান্য করার কারণে মুসলমানরা কঠিন বিপর্যয়ের সম্মুখিন হন। একপর্যায়ে মুজাহিদরা রাসুল সা. কে একা ফেলে বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়, এতে কাফেররা রাসুল সা. কে হত্যার জন্য ঘিরে ফেলে। এমতাবস্থায় সাহাবী তালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ রা. দৌড়ে এসে আল্লাহর নবীকে ঘিরে ধরলেন। পেছন থেকে রাসুল সা. কে লক্ষ্য করে কাফিরদের নিক্ষিপ্ত যত তীর, বর্শা আসছিল তালহা রা. সবগুলো নিজের পিঠে গ্রহণ করছিলেন। একবারের জন্যও রাসুল সা. এর প্রতি নিজের চেহারা অন্যদিকে ফেরাননি। এতে তার পিঠে সত্তরটিরও বেশী তীর বিধেছিল। (সহীহ বুখারী- ২য় খন্ড)
১। যারা আদর্শ মানুষ-রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, মানুষ তার বন্ধুর আদর্শ বা রীতিনীতির উপর পরিচালিত হয়, সুতরাং তোমাদর প্রত্যেকের উচিৎ কাকে তোমার বন্ধু নির্বাচন করেছ এ ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করা। (সুনানে তিরমিযি)
২। যারা দ্বীনদার ও তাকওয়াবান-আল্লাহ তা’য়ালা বলেন- সেইদিন (কিয়ামতের দিন) বন্ধুরা একে অপরের শক্র হবে, তবে মুত্তাকীরা ব্যতীত। (সুরা যুখরুফ-৬৭)
রাসুলুল্লাহ সা. বলেন- ইমানদার ব্যাতীত কাউকে সাথী গ্রহণ করোনা, মুত্তাকী ব্যাতীত কেহ যেন তোমার খাবার ভক্ষণ না করে। (সুনানে তিরমিযি)
৩। যারা ইমানদার-আল্লাহ তায়ালা বলেন- হে ইমানদারগণ! তোমরা ইমানদার ব্যতীত কাফিরদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করোনা। (সুরা নিসা-১৪৪)
৪। যারা বুদ্ধিমান ও চরিত্রবান-আলী রা. বলেন- খবরদার! তোমরা মুত্তাকী, চরিত্রবান, মেধাবী ও ওয়াদা পালকনারী ব্যতীত কাউকে বন্ধু বানাবেনা। (দিওয়ানে আলী)
৫। যারা আল্লাহওয়ালা-রাসুলুল্লাহ সা. বলেন- আল্লাহর প্রিয় বান্দাহ তো তারাই, যাদেরকে দেখলে আল্লাহর কথা স্বরণ হয়। (মিশকাতুল মাসাবীহ)
৬। আল্লাহ তা’য়ালা যাদেরকে ভালবাসেন তাদেরকে ভালবাসা
* আল্লাহ তা‘য়ালা সৎকর্মশীলদেরকে ভালবাসেন। (সুরা আলে ইমরান-১৪৮)
* আল্লাহ তা‘য়ালা পবিত্রতা পবিত্রতা অর্জনকারীদের ভালবাসেন। (সুরা তাওবা ১০৮)
* নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘য়ালা ন্যায়বিচারকারদের ভালবাসেন। (সুরা হুজরাত-০৯)
* নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘য়ালা মুত্তাকীদেরকে ভালবাসেন। (সুরা আলে ইমরান-৭৬)
*আর আল্লাহ তা‘য়ালা ছবরকারীদেরকে ভালবাসেন। (সুরা আলে ইমরান-১৪৬)
* নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’য়ালা তাওয়াক্কুলকারীদেরকে ভালবাসেন। (সুরা আলে ইমরান-১৫৯)
* নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’য়ালা তাদেরকে ভালবাসেন যারা তার পথে সারিবদ্ধ হয়ে যুদ্ধ করে যেন তারা সীসাঢালা প্রাচীর। (সুরা ছফ-০৪) নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’য়ালা তাওবাকারীদের ভালবাসেন। (সুরা বাকারা-২২২)
৭। আল্লাহ যাদেরকে ভালবাসেন না তাদেরকে বর্জন করা-* নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’য়ালা সীমালঙ্ঘনকারীদের ভালবাসেন না।
(সুরা বাকারা-১৯০)
* আর আল্লাহ তা’য়ালা প্রত্যেক পাপীষ্ট কাফিরদেরকে ভালবাসেন না-সুরা বাকারা-২৭৬
* নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’য়ালা যালেমদেরকে ভালবাসেন না। (সুরা আলে ইমরান-১৪০)
* নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’য়ালা অযথা অট্ট হাসা-হাসিকারীদের ভালবাসেন না। (সুরা কাসাস-৭৬)
* নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’য়ালা অহংকারীদের ভালবাসেন না। (সুরা নিসা-৩৬)
* নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’য়ালা অপচয়কারীদের ভালবাসেন না। (সূরা আনআম-১৪১)
* নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’য়ালা প্রত্যেক পাপীষ্ট ও আমানতের খিয়ানতকারীদের ভালবাসেন না। (সুরা আনফাল-৫৮)
* আল্লাহ তা’য়ালা মন্দকথা প্রকাশকারীদের ভালবাসেন না। (সুরা নিসা-১৪৮)
* আর আল্লাহ তা’য়ালা ফাসাদ সৃষ্টিকারীদের ভালবাসেন না। (সুরা বাকারা -২০৫)।
৮। আল্লাহ ও রাসূলের ভালবাসার পাত্রকে ভালবাসা-* আল্লাহ তা’য়ালার নিকট প্রিয় (ক) আল্লাহর স্মরণকারী জিহবা
(খ) কৃতজ্ঞতা প্রকাশকারী অন্তর (গ) বিপদে ধৈর্যধারণকারী আত্বা। (মিশকাতুল মাসাবীহ)
* আল্লাহ তা’য়ালার নিকট তিন ধরণের আওয়াজ প্রিয় (ক) ভোর রাতে মোরগের ডাক (খ) কুরআন তিলাওয়াতের আওয়াজ (গ) ভোর রাতে ক্ষমাপ্রার্থীর গুণগুণ আওয়াজ। (মিশকাতুল মাসাবীহ)
* রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’য়ালা কোমল, তিনি কোমলতাকে ভালবাসেন। (সহীহ মুসলিম)
* রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’য়ালা সুন্দর, তিনি সুন্দর চরিত্রকে ভালবাসেন। (মিশকাতুল মাসাবীহ)
* রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, আমার নিকট তিনটি বস্তু প্রিয় (ক) সুগন্ধি (খ) সতী-সাধ্বি নারী (গ) সালাতে চক্ষুর শীতলতা। (মিশকাতুল মাসাবীহ)
১। হাসিমুখে সাক্ষাৎ করা-রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, কোন ভাল কাজ কখনো তুচ্ছজ্ঞান মনে করোনা, এমনকি তা যদি তোমার ভাইয়ের/বন্ধুর সাথে হাস্সোজ্জল চেহারায় সাক্ষাৎ করাও হয়। (সহীহ মুসলিম) অপর বর্ণণায় আছে- রাসুল সা. বলেন তোমার ভাই/বন্ধুর সাথে হাসিমুখে কথা বলাও সদকা দানের সমান সাওয়াব। (মিশকাতুল মাসাবীহ)
২। সালামের প্রচলন করা-রাসুলুল্লাহ সা. বলেন- আমি কি তোমাদেরকে এমন এক বিষয়ের কথা বলব! যা প্রতিপালন করলে তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালবাসা বৃদ্ধি পাবে ? তাহলো- তোমরা নিজেদের মধ্যে ব্যাপকহারে সালামের প্রচলন কর।
(সহীহ মুসলিম)
৩। মুসাফাহা করা (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে)-রাসুলুল্লাহ সা. বলেন- যখন দু’জন মুসলমান পরস্পর মিলিত হয়ে মুসাফাহা করে, অতঃপর তারা আল্লাহর প্রশংসা করে এবং আল্লাহর নিকট ক্ষমা চায় তখন তাদেরকে পৃথক হওয়ার পূর্বেই সগীরা গুণাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়। (সুনানে আবু দাউদ)
৪। ভালবাসার কথা প্রকাশ করা-রাসুলুল্লাহ সা. বলেন- মানুষ যখন তার কোন ভাইকে ভালবাসে সে যেন তাকে অবহিত করে যে, সে তাকে ভালবাসে এবং বলে নিশ্চয়ই আমি আপনাকে আল্লাহর জন্য ভালবাসি। (মিশকাতুল মাসাবীহ)
৫। হাদীয়া প্রদান করা-রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, তোমরা একে অপরকে হাদীয়া/উপহার প্রদান কর। এতে তোমাদের পরস্পরের মধ্যে ভালবাসা বৃদ্ধি পাবে। (মুয়াত্তায়ে ইমাম মালিক)
৬। দুয়া করা-রাসুলুল্লাহ সা. বলেন- কোন মুসলিম বান্দাহ যখন তার ভাইয়ের পেছনে তার জন্য দু’য়া করে তখন ফেরেস্তারা বলে উঠে তোমার জন্যও অনুরুপ। (সহীহ মুসলিম)
৭। সাহায্য-সহযোগিতা করা-রাসুলুল্লাহ সা. বলেন- যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের/বন্ধুর বৈধ প্রয়োজন পূরণ করে দিবে আল্লাহ তা’য়ালাও তার প্রয়োজন পূরণ করে দিবেন। (সহীহ বুখারী)
৮। দোষ-ত্রুটি গোপন রাখা-রাসুলুল্লাহ সা. বলেন- যে ব্যক্তি কোন মুসলমান ভাইয়ের/বন্ধুর দোষ-ত্রুটি গোপন রাখে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা’য়ালাও তার দোষ-ত্রুটি গোপন রাখবেন। (মিশকাতুল মাসাবীহ)
৯। ওয়াদা পালন করা-রাসুলুল্লাহ সা. বলেন- সম্মানিত ব্যক্তি হলো সে, যে ওয়াদা পূরণ করে। (মিশকাতুল মাসাবীহ)
১০। দয়া করা-রাসুলুল্লাহ সা. বলেন- আল্লাহ তা’য়ালা সে ব্যক্তির প্রতি দয়া করেন না, যে মানুষের প্রতি দয়া করে না। (বুখারী ও মুসলিম)
১১। ব্যয় করা-রাসুলুল্লাহ সা. বলেন- মধ্যমপন্থায় খরচ করা জীবন যাপনের অর্ধেক, মানুষকে ভালবাসা আকলের অর্ধেক, আর সুন্দরভাবে প্রশ্ন করা জ্ঞানের অর্ধেক। (সুনানে বায়হাকী)
১২। কোমল হওয়া-রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, আল্লাহ তা’য়ালা স্বয়ং কোমল এবং তিনি কোমলতাকে ভালবাসেন। (মিশকাতুল মাসাবীহ)
১৩। লজ্জাশীল হওয়া-রাসুলুল্লাহ সা. বলেন-লজ্জাশীলতা ইমানের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যার লজ্জা নেই তার ইমান নেই। (মিশকাতুল মাসাবীহ)
১৪। সম্মান করা-রাসুলুল্লাহ সা. বলেন-যে ব্যক্তি আমাদের ছোটদের কে স্নেহ করেনা এবং বড়দেরকে সম্মান করেনা সে আমাদের উম্মাহর অন্তর্ভুক্ত নয়। (মিশকাত)
১৫। আপ্যায়ন করা-রাসুলুল্লাহ সা. বলেন- যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ^াস রাখে, তার উচিৎ মেহমানের সম্মান/আপ্যায়ন করা। (মিশকাতুল মাসাবীহ)
১৬। নিম্নস্বরে কথা বলা-আল্লাহ তায়ালা বলেন- তুমি তোমার আওয়াজকে নিম্ন কর। নিশ্চয়ই নিকৃষ্ট আওয়াজ হল গাধার আওয়াজ। (সুরা লুকমান-১৯)
২. স্বভাবগত ভালবাসা-আল্লাহ তা’য়ালা বলেন-মানবজাতীর জন্য সুশোভিত করা হয়েছে- নারী, সন্তানাদি, পুঞ্জীভুত সোনা-রূপা, সম্পদ, চিহ্নিত ঘোড়ার পাল, গৃহপালিত পশু ও শস্যক্ষেত। তবে, এগুলো দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী সম্পদ। বস্তুতঃ মহান আল্লাহ তা’য়ালার নিকটই রয়েছে উত্তম আশ্রয়স্থল। (সুরা আলে ইমরান-১৪)
ক) পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের ভালবাসা-আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন এক ব্যক্তি আরয করল, হে আল্লাহর রাসূল! আমার সাহচর্যে সবচেয়ে বেশি সদাচার পাওয়ার অধিকারী কে? তিনি বললেন, তোমার মা। লোকটি বললঃ তারপকে কে? রাসূল সা. বললেন, ‘তোমার মা। লোকটি আবার জিজ্ঞেস করল, তারপর কে? রাসূল সা. বললেন তোমার মা। লোকটি আবারো বলল, তারপর কে? রাসূল সা. বললেন তোমার বাবা। (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)
খ) সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার ভালবাসা-আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, একদা রাসূল সা. হাসান ইবনে আলী রা. কে চুম্বন করলেন। এ সময় মহানবী সা. এর নিকট আকরা ইবনে হারেস রা. উপস্থিত ছিলেন, তখন আকরা ইবনে হারেস রা. বললেন, আমার ১০টি সন্তান আছে, আমি তাদের কাউকে চুম্বন করিনা। এ কথা শুনে রাসূল সা. তার দিকে তাকালেন। অতঃপর বললেন, যে ব্যক্তি দয়া করেনা তার প্রতি দয়া করা হয় না। (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)
গ) সৃষ্টি জীবের প্রতি ভালবাসা-রাসুলুল্লাহ সা. বলেন-সকল সৃষ্টি আল্লাহর পরিবার। (মিশকাতুল মাসাবীহ)
রাসুলুল্লাহ সা. আরও বলেন- তোমরা দুনিয়াবাসীর প্রতি দয়া কর, এতে করে আসমানে যারা আছেন তারাও তোমাদের প্রতি দয়া করবেন। (মিশকাত)
* আল্লাহ তা’য়ালার বাণী-‘‘আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের থেকেই স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন। যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি পাও। আর তিনি তোমাদের মধ্যে ভালবাসা ও দয়ার সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয়ই এর মধ্যে শিক্ষা রয়েছে সে কাওমের জন্য, যারা চিন্তাশীল’’। (সূরা রুম-২১)
* রাসুলুল্লাহ সা. বলেন- তোমাদের মধ্যে উত্তম সে ব্যক্তি, যে তার স্ত্রী কাছে উত্তম। আর আমি আমার স্ত্রীর কাছে উত্তম। (সুনানে নাসায়ী)
* রাসুলুল্লাহ সা. বলেন-উত্তম স্ত্রী হলো সে, স্বামী যার দিকে তাকালে সে স্বামীকে আনন্দ দান করে। (সুনানে তিরমিযি)
* রাসুলুল্লাহ সা. বলেন-যখন স্বামী-স্ত্রী একে অন্যের প্রতি মহব্বতের দৃষ্টি বিনিময় করে, তখন আল্লাহ তা’য়ালা তাদের উভয়ের প্রতি রহমত বর্ষন করেন। (সহীহ বুখারী)
* রাসুলুল্লাহসা. বলেন- স্ত্রীকে খাইয়ে দেয়া সুন্নাত। ঘরের কাজে সাহায্য করা সুন্নাত। স্ত্রীর সাথে শরীয়াহ সম্মত হাসি ঠাট্টা করাও সুন্নাত। (সুনানে তিরমিযি)
* রাসুলুল্লাহ সা. বলেন- কোন স্বামী তার স্ত্রীকে নিজ প্রয়োজন পূরণের উদ্দেশ্যে ডাকলে সে যেন সাথে সাথে ডাকে সাড়া দেয়। এমনকি সে চুলার উপর রান্নার কাজে ব্যস্ত থাকলেও। (সুনানে তিরমিযি)
* আম্মাজান আয়েশা রা. পানি পানের সময় গ্লাসের যে স্থানে ঠোঁট রেখে পানি পান করতেন, রাসুলুল্লাহ সা. ঠিক সেই স্থানে ঠোঁট রেখে পানি পান করতেন। (সহীহ মুসলিম)
* স্ত্রীর সাথে চুল আঁচড়ানো সুন্নাত। আয়েশা রা. রাসূল সা. এর চুল মোবারক আঁচড়ে দিতেন। (সহীহ বুখারী)
* রাসুলুল্লাহ সা. তাঁর স্ত্রীর সাথে একই পাত্রে গোসল করতেন। (সহীহ মুসলিম)
* রাসুলুল্লাহ সা. বলেন-স্ত্রীর ভাল কাজের প্রশংসা করা সুন্নাত। তাকে নিয়ে সফর করাও সুন্নাত। (সহীহ বুখারী)
* রাসুলুল্লাহ সা. বলেন- স্ত্রীর রাগ-অভিমান এবং মন বোঝার চেষ্টা করা সুন্নত। (সহীহ বুখারী)
* রাসুলুল্লাহ সা. বলেন- স্বামীর সন্তুষ্টি থাকাবস্থায় কোন স্ত্রী মারা গেলে সে জান্নাতী। (সুনানে তিরমিযী)
* রাসুলুল্লাহ সা. বলেন- স্বামী তার স্ত্রী হাতে হাত রাখলে সগীরা গুনাহ মাফ হয়, চেহারার দিকে তাকালে চোখের গুনাহ মাফ হয়। স্ত্রীর জন্য খরচ করলে নেকী হয় এবং তার সাথে মিলন করলে সওয়াব হয়। (জামেউস সুনান)
* স্ত্রীকে সালাম দেয়া সুন্নাত। আয়েশা রা. বলেন-আমি কখনো রাসুলুল্লাহ সা.কে প্রথমে সালাম দিতে পারিনি। বরং তিনিই আমাকে প্রথমে সালাম দিয়েছেন। (মিশকাতুল মাসাবীহ)
* আল্লাহ তা’য়ালা বলেন-তোমরা যিনা/প্রেম ভালবাসার ধারে কাছেও যেওনা, কারণ এটি একটি লজ্জাজনক ও নিকৃষ্ট কর্ম, যা অন্যান্য নিকৃষ্ট কর্মের পথ খুলে দেয়। (সূরা বনী ইসরাইল-৩২)
* আল্লাহ তা’য়ালা বলেন-‘অতঃপর যারা নিজ স্ত্রী ছাড়া অন্য কাউকে কামনা করে তারাই সীমালঙ্ঘনকারী। (সুরা মুমিনুন-০৭)
* আল্লাহ তা’য়ালা বলেন-তারা (নারীরা) যেন তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। (সুরা নুর- )
* রাসুলুল্লাহ সা. বলেন-দু’চোখের যিনা হলো (নিষিদ্ধ যৌনতার প্রতি) দৃষ্টিপাত করা, দু’কানের যিনা হলো (যিনা সংশ্লিষ্ট কথা) শ্রবণ করা, জিহবার যিনা হলো কথোপকথন করা, হাতের যিনা হলো স্পর্শ করা, পায়ের যিনা হলো হেটে যাওয়া, অন্তরের যিনা হলো আকাঙ্খা করা। অবশেষে যৌনাঙ্গ তা বাস্তবায়িত করে। (সহীহ বুখারী)
* মি’রাজ রজনীতে রাসুলুল্লাহ সা. জাহান্নামিদের শাস্তির একটি দৃশ্য দেখলেন, একদল নর-নারীর পাশে সুস্বাদু ও পঁচা দুর্গন্ধযুক্ত দু’ধরণের রান্না করা খাবার সাজানো আছে, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো লোকগুলো সুস্বাদু খাবার গ্রহণ না করে পঁচা দুর্গন্ধযুক্ত খাবারগুলো গো-গ্রাসে খাচ্ছে। রাসুলুল্লাহ সা. জিবরাইল আ. কে প্রশ্ন করলেন ভাই এই খবিসের দল কারা ?
জিবরাইল আ. বললেন-এরা আপনার উম্মতের ঐ সকল লোক, যারা হালাল স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও অন্য নারীর সাথে পরকীয়ায় লিপ্ত, অনুরূপভাবে যারা স্বামী থাকার পরও গোপনে পরপুরুষের সাথে পরকীয়ায় লিপ্ত রয়েছে, তারা কিয়ামত পর্যন্ত এ পঁচা দুর্গন্ধযুক্ত খাবার খেতে থাকবে। (তাফসীরে ইবনে কাসীর)
* রাসুলুল্লাহ সা. বলেন- পাঁচ কাজে তাড়াতাড়ি করা উচিত। ১। সালাত- যখন সময় হয় ২। জানাযা-যখন উপস্থিত হয় ৩। সন্তান-যখন বিবাহের উপযুক্ত হয় ৪। মেহমানদারী ৫। তাওবাহ-যখন অপরাধ সংগঠিত হয়। (মিশকাতুল মাসাবীহ)
নির্ধারিত দিবস কেন্দ্রিক ভালবাসা উদযাপন ইসলামি সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত নয়, এটি কেবলমাত্র চতুষ্পদ প্রাণীদের স্বভাব । একজন মুসলিম আজীবন-আমরণ আল্লাহ তা’য়ালা, রাসূল সা. কুরআন-সুন্নাহ ও ইসলামি নিদর্শন, পিতা-মাতা, স্ত্রী ও সন্তানকে ভালবাসবে। এটাই ইমানের দাবী। বর্তমান পৃথিবীতে ১৪ই ফেব্রুয়ারী ভ্যালেন্টাইনস’ডে/বিশ্ব ভালবাসা দিবস পালনের নামে যে ধরণের অশ্লীলতা, বেহায়াপনা ও অপসংস্কৃতি রয়েছে এটি খৃষ্টান ধর্মের সামাজিক উৎসব। কারণ ভ্যালেন্টাইন একজন খৃষ্টান দেবতার নাম। অতএব, ভ্যালেন্টাইনস’ডে অথবা বিশ্ব ভালবাসা দিবস উদযাপন করা মুসলিম উম্মাহর জন্য সম্পূর্ণরূপে হারাম। তাইতো রাসুলুল্লাহ সা. বলেন- যে ব্যক্তি যার সাথে সাদৃশ্য রাখবে, কিয়ামত দিবসে সে তার সাথেই থাকবে। (সুনানে আবু দাউদ)
* রাসুলুল্লাহ সা. বলেন- যদি নাক কাটা হাবশী গোলামকেও যোগ্যতার কারণে তোমাদের আমির বানানো হয়, তবে তোমরা তার অনুস্বরণ করবে। (সুনানে তিরমিযি)
* আল্লাহ ও রাসুলের প্রতি আনুগত্যের মাধ্যমে ভালবাসা- ফরজ
* সন্তানের জন্য পিতা-মাতার প্রতি খেদমতের মাধ্যমে ভালবাসা- ওয়াজিব
* স্বামী-স্ত্রীর প্রতি ভালবাসা গোনাহ মাফের মাধ্যম ও সুন্নাত। এছাড়া সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার ভালবাসা, সমস্ত নেককারদের প্রতি ভালবাসা, সৃষ্টিজীবের প্রতি ভালবাসা ও মাতৃভূমির প্রতি ভালবাসাও সুন্নাত।
* যুবক-যুবতীর বিবাহ বহির্ভুত অনৈতিক ভালবাসা, নির্ধারিত দিবস কেন্দ্রিক ভালবাসা উদযাপন ও অমুসলিমদের প্রতি আন্তরিক ভালবাসা সম্পূর্নরূপে হারাম।
** তথ্য সূত্র –
১। আলকুরআনুল কারীম
২। তাফসীরে ইবনে কাসীর
৩। সহীহ আল বুখারী
৪। সহীহ আল মুসলিম
৫। সুনানে নাসায়ী
৬। সুনানে তিরমিযি
৭। সুনানে আবি দাউদ
৮। সুনানে ইবনে মাযাহ
৯। মুয়াত্তায়ে ইমাম মালিক
১০। মিশকাতুল মাসাবীহ
১১। জামেউস সুনান
১২। সুনানে বায়হাকী
১৩। দারে কুতনি
১৪। তাবরানী
১৫। মু’জামুল আওসাত
১৬। দিওয়ানে আলী
১৭। ইশকে ইলাহী