বুধবার , ২১শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ || ৭ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
তাবারক হোসেন আজাদ, লক্ষ্মীপুর:
ঈদুল ফিতর উপলক্ষ্যে গরীব দুঃখি অসহায়দের জন্য সরকার ২২০০৭টি ভিজিএফ এর কার্ড দিয়েছে। কিন্তু এই কার্ড আমাদের ভাগ্যে জুটলোনা।
ইউএনওর কাছে গেলেও তিনি আশ্বাস দিয়েও দিলেননা। এটাই কি আমাদের নিয়তি? বুধবার সরেজমিনে লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার বামনী ইউপির পালবাড়ী ও দক্ষিন চরবংশী ইউপির হাজিমারা আশ্রয়কেন্দ্রে গেলে দরীদ্র পরিবারগুলো এপ্রতিবেদককে এ প্রশ্রগুলো করেন। পেলো রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা। এই ভিজিএফ এর কার্ডগুলো ১০টি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, মেম্বার, বিএনপি, জামায়াত, ইসলামি আন্দোলন ও সমন্বয়কের মধ্যে ভাগ বন্টন এবং চাউলও দেয়া হয়ে গেছে।
এতে সরকারের বিশেষ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কায় প্রকৃত অতিদরিদ্র ও দুস্থ পরিবার।
উল্লেখ্য-রায়পুরের দক্ষিন চরবংশী ইউপির মেঘনার পাড়ে হাজিমারা আশ্রয়ন কেন্দ্রে-১০৪, তার পাশে আবাসন কেন্দ্রে-৫০, মিয়ারহাট বাজারের পাশে-৪১, কারিমিয়া আশ্রয়নকেন্দ্রে -১১১, মদিনা বাজার আশ্রয়কেন্দ্রে -৪০, দক্ষিন চরআবাবিল ইউপির উদমারা গ্রামের আশ্রয়নকেন্দ্রে-৭০, বামনী ইউপির পাল বাড়ী আশ্রয়কেন্দ্রে ১০৪, মীরগন্জ বাজার আশ্রয়ন কেন্দ্রে ১০টি দরীদ্র পরিবার বসবাস করছেন।
জানাযায়, আসন্ন ঈদুল ফিতর উপলক্ষ্যে রায়পুর পৌরসভাসহ ১০টি ইউনিয়নের গরিব ও দুস্থদের জন্য সরকারি ৫৭২ টন ভিজিএফের চাল বরাদ্দ আসে। এসব চাল ২২ হাজার ৮টি কার্ডের বিপরীতে জনপ্রতি ১০ কেজি করে বিতরণ করা হবে। এ লক্ষ্যে গেল সপ্তাহে ইউনিয়ন ভিত্তিক বরাদ্দ বণ্টনের পর সংশ্লিষ্ট পরিষদ তালিকা প্রস্তুতির উদ্যোগ নেয়।
কিন্তু এতে বাধা হয়েছিলো রাজনৈতিক দলগুলো। সম্প্রতি ইউনিয়ন পরিষদের সভাগুলোতে উপস্থিত হয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা ‘কোটার’ ভিত্তিতে কার্ড বণ্টনের দাবি করেছিলেন। চাপের রাজনৈতিক দলের নেতাদের দাবি মেনে নিয়েছিলেন পরিষদের দায়িত্বশীলরা।
এতে রায়পুর, সোনাপুর, চরআবাবিল, বামনী, কেরোয়া ইউনিয়ন বিভিন্ন স্থানে এনিয়ে দলীয় কর্মীর মধ্যে হট্টাগোল হয়। নাম প্রকাশ না করা শর্তে কয়েকজন জনপ্রতিনিধি ও গ্রামবাসী জানান, প্রথমে সম্মত না হলেও বিএনপি, জামায়াত, ইসলামি আন্দোলন ও সমন্বয়ক নেতাদের বিভিন্নমুখী চাপে ইউপি চেয়ারম্যান ও প্রশাসকরা দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন। এভাবে প্রভাব বিস্তার করে ‘কোটার’ ভিত্তিতে শতকরা হারে নিজ নিজ দলের জন্য কার্ড আদায় করে নিয়েছেন।
রাজনৈতিক দলের নেতাদের ‘বদনজর’ পড়ার ভয়ে এসব নিয়ে কথা বলেননি চেয়ারম্যান, সচিব ও প্রশাসকরা।
প্রকল্প বাস্তবায়ন (পিআইও) কার্যালয় সূত্রে জানাযায়, রায়পুর পৌরসভার জন্য ৪৭২৬টি, উত্তর চরআবাবিল ইউপিতে ২৩৯৪, উত্তর চরবংশী ইউপিতে ৩৩০৫, চরমোহনা ইউপিতে ২২৮৭, চরমোহনা ইউপিতে ২০৭৫, চরপাতা ইউপিতে ১৩৩৮, কেরোয়া ইউপিতে ২৭৬১, বামনী ইউপিতে ২২৫৫, দক্ষিন চরবংশী ইউপিতে ২৪৩৬, দক্ষিন চরআবাবিল ইউপিতে ২১০১ ও রায়পুর ইউপিতে ১০৫৫টি ভিজিএফ এর কার্ড বরাদ্ধ দেয়া হয়েছে।
বামনী ইউপির পালবাড়ীর আশ্রয়কেন্দ্রের সভাপতি মোঃ হাসিম, সেক্রেটারী হাসিনা বেগম, লুবনা রানী দাস, মোঃ আজিদ, মোঃ মিন্টু, সুপিয়া বেগম, নাসিমা বেগম-বলেন- ১০৪টি ঘরের মধ্যে- ৭০-৮০টি ঘরে মানুষ বসবাস করেন।
ভিজিএফ নিয়ে নেতাদের থাবার ফলে আমরা প্রকৃত দুস্থ পরিবার সরকারি বিশেষ সুবিধা থেকে বাদ পড়লাম। পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, ভিজিএফের কার্ড যেন দুস্থদের জন্য নয়; দলীয় নেতাকর্মীদের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। একই অভিযোগ করেছেন হাজিমারা আশ্রয়কেন্দ্রের সেক্রেটারি রিয়াজ হোসেন জমাদারসহ ৮ জন নারী-পুরুষ বাসিন্দা।
কয়েকজন ইউপি চেয়ারম্যান অভিযোগ করে বলেন, কার্ড বিতরণের সময় এলে দলীয় কোটা রাখা একটি অলিখিত নিয়ম হয়ে গেছে। শুধু ঈদে নয়; জেলেদের ভিজিএফসহ সরকারি বিভিন্ন বরাদ্দে রাজনৈতিক দলের নেতারা ভাগ করে নিয়ে যান।
বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের সময়ও এ প্রথা চালু ছিল। বর্তমানে এ ‘কোটার’ হার অনেক বেড়েছে। দক্ষিন চরআবাবিল ইউপি চেয়ারম্যান নুরে আলম জিকু বলেন, নির্দিষ্ট সংখ্যক কার্ড বহু কষ্টে নিজেদের জন্য বরাদ্দ রেখেছি। না হলে চেয়ারম্যানি করাই কঠিন হয়ে পড়েছে। সব কিছু বিএনপি ও জামায়াত ভাগ করে নিয়ে গেছে। আমার বরাদ্ধেরগুলো আশ্রয়কেন্দ্রের বাসিন্দাদের ভাগ করে দিয়েছি।
আরও ৬টি আশ্রয়কেন্দ্রের বাসিন্দারা পাননি বলে শুনেছি। ইসলামি আন্দোলনের সাধারন সম্পাদক মাওলানা হেলাল উদ্দিন বলেন, দরিদ্রদের জন্য ভিজিএফের কার্ড নিয়ে রাজনীতি হয়েছে। সব ইউনিয়নে বিএনপিকে বেশি বেশি করে নিয়ে গেছে।
এনিয়ে কয়েকটি ইউনিয়নে জামায়াত ও বিএনপির মধ্যে বাকবিতন্ডাও হয়েছে। আমার ইউনিয়নে ( সোনাপুর ইউপির) গরিবদের জন্য যুদ্ধ করে ১০০টি কার্ড নিতে পেরেছি।
এ ব্যাপারে উপজেলা জামায়াতের আমির মাওলানা নাজমুল হুদা বলেন, জামায়াতে ইসলামী সব সময় কোটার বিরুদ্ধে।
জামায়াতের নেতাকর্মীরা এর সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। ১০টি ইউপিতে ২০০- ৬০০ পর্যন্ত কার্ড পেয়েছি। বিএনপি সবসময় বেশি বেশি নিতে চায়। তাদের কারনে ঝামেলাও পড়তে হয়েছে। উপজেলা বিএনপির আহবায়ক নাজমুল ইসলাম মিঠু বলেন, দলীয়ভাবে আগে থেকেই এই ধরনের কোটার বিরুদ্ধে। কেউ বিএনপির নাম ভাঙিয়ে কোটা সিস্টেমে কার্ড নিলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
লক্ষ্মীপুর জেলা সুজন সভাপতি মো. কামাল হোসেন বলেন, কোটা প্রথাকে কেন্দ্র করে দেশে এতো কিছু হয়ে যাওয়ার পরেও সেই প্রথা এখনও চালু থাকা খুবই দুঃখজনক।
রায়পুর ইউএনও মো. ইমরান হোসেন বলেন, ২২০০৭টি ভিজিএফ কার্ড পৌরসভাসহ ১০টি ইউনিয়ন পরিষদকে ভাগ করে দেয়া হয়েছে।
কার্ডগুলো বিতরন নিয়ে বিভিন্ন দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে বাকবিতন্ডা হয়েছে বলে অভিযোগ পেয়েছি। আশ্রয়কেন্দ্রের বাসিন্দারা কেন চাউল পেলোনা খোঁজ নিবো।