লক্ষ্মীপুরে কিশোর গ্যাং হামলায় নাপিতের মৃত্যু ! বিচার দাবিতে মানববন্ধন

তাবারক হোসেন আজাদ, লক্ষ্মীপুরঃ

লক্ষ্মীপুরের রায়পুরসহ পাঁচ উপজেলায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছে কিশোর গ্যাং। প্রভাবশালী ব্যাক্তি ও কথিত রাজনৈতিক ‘বড় ভাইদের’ ছত্রছায়ায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তারা। শহর ও গ্রামের বিভিন্ন এলাকায় ‘লাঠিসোঁটা ও অস্ত্র নিয়ে’ তাদের প্রকাশ্য মহড়া ও দৌড়াদৌড়ি নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোন ব্যাক্তি প্রতিবাদ করলেই তাদের লাঞ্চিত ও মারধর করা হচ্ছে। চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ডাকাতি, দাঙ্গা-হাঙ্গামা সহ সব ধরনের অপরাধেই জড়িয়ে পড়ছে তারা। এসব অপরাধীর অনেকে আবার জুয়া ও মাদকাসক্ত। এসব অপরাধে কিশোর গ্যাংয়ের একজনকেও আটক করছে না।

এদিকে এদের নিয়ন্ত্রণও করা যাচ্ছে না। কিশোর গ্যাংয়ের অপতৎপরতা রুখতে প্রতিটি ইউনিয়নে মতবিনিময় সভা হয়েছিলো। সম্প্রতি উৎপাত বেড়ে যাওয়ায় জেলা গোয়েন্দা সংস্থা থেকে কিশোর অপরাধী ও তাদের মদদদাতাদের তালিকা তৈরিরও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

গত ৩ এপ্রিল সন্ধায় রায়পুর উপজেলার দক্ষিন চরআবাবিল ইউপির উদমারা গ্রামের লাঠিয়াল এলাকায়  সমাজসেবক জাহাঙ্গিরসহ তার ছেলে, মেয়ে ও ভাইকে হামলা ও কোপাঘাতে জখম করার ঘটনা ঘটে।

এ ঘটনায় ৭ এপ্রিল জোবায়ের, তানভির, নাবিল ও ছাব্বিরসহ ৯ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতপরিচয় আরও ১৫জনকে আসামি করে মামলা করেছেন আহত জাহাঙ্গিরের স্ত্রী রাজিয়া সুলতানা।

হামলাকারীরা স্থানীয় বিএনপি নেতা মামুনের অনুসারী বলে অভিযোগ করেছেন জাহাঙ্গির।

শনিবার (১২ এপ্রিল) আসামীদের গ্রেপ্তারের দাবিতে রায়পুর শহরের ট্রাফিক মোড়ে মানববন্ধন করেছেন আহতদের শতাধিক স্বজন ও গ্রামবাসী।

এসময় বক্তব্য রাখেন-নজরুল ইসলাম, মেহেদী হাসান, আবুল কাশেম,রায়হান, জাবের, আশ্রাফুল ও সাব্বির।

সংশ্লিষ্ট জানাযায়, শতাধিক কিশোর গ্যাং সক্রিয় রয়েছে। একেক দলে রয়েছে ১০ থেকে ১৫ জন।

তাদের প্রশ্রয় দিচ্ছে স্থানীয় আ’লীগ ও বিএনপির একাধিক রাজনৈতিক নেতা ও প্রভাবশালী ব্যাক্তিরা। বেশি অপকর্মে কিশোর গ্যাং জড়িত বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করে।

গত ৩ এপ্রিল সন্ধায় উপজেলার দক্ষিন চরআবাবিল ইউপির উদমারা গ্রামের লাঠিয়াল এলাকায় রাস্তার পাশে বাড়ীর সামনে টং ঘরে বসে মোবাইলে গেমস খেলছিলো স্কুল ছাত্র জাবেদসহ তার বাড়ীর কয়েকজন কিশোর। এসময় অন্ধকারে কে বা করার তাদেরকে ঢিল ছোড়ে। এতে ওই কিশোররা গালমন্দ করে।

এসময় ঘটনা জানতে চাইলে দিনমজুর আবুল কাশেমসহ ৩ জন কিশোর গ্যাংয়ের হামলার মুখে পড়েন । কাশেমের মাথায় ইট ও ছুড়ি দিয়ে জখম করা হয়। এসংবাদ শুনে বড় ভাই জাহা্ঙ্গির অন্য জায়গা থেকে বাড়ীতে ছুটে আসলেই জোবায়ের, তানভির, নাবিলসহ ৮-১০ জন সেনি ও ছুরি দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে রক্তাক্ত জখম করে।

এসময় বাবাকে বাঁচাতে মেয়ে শারমিন এগিয়ে আসলে তাকেও কুপিয়ে রক্তাক্ত জখম করে  কিশোরগ্যাং। বর্তমানে জাহাঙ্গির (৫২) ও তার মেয়ে শারমিন আক্তার (৩০) ঢাকা মেডিকেল চিকিৎসাধীন রয়েছে। যে কোন সময় মারা যেতে পারেন বলে তার ছোট ভাই জসিম হাসপাতাল থেকে জানিয়েছেন।

এঘটনায় অভিযুক্ত কিশোর তানভিরের খোঁজে এলাকায় গেলে পলাতক থাকায় বক্তব্য নেয়া যায়নি। তার মা তাসলিমা বেগম বক্তব্য দিতে চাইলে  বিএনপি নেতা মমিন মোবাইল ফোনে জানান কোন বক্তব্য দেয়া যাবেনা, আপনার সাথে পরে কথা বলবো বলে ফেন কেটে দেন।

অপরদিকে- গত ১৫ রমজান সন্ধার পর উদমারা গ্রামের লাঠিয়াল এলাকার মন্দিরের পাশের সুপারির বাগানে জুয়ার আসর বসে।

এতে অংশগ্রহন করে স্থানীয় মৃত বরদা কান্ত শীলের ছেলে নাপিত সুদেব শীল মনুকে (৫১) জুয়া খেলার অপরাধে পিটিয়ে আহত করে কিশোর গ্যাং সদস্যরা।

এসময় স্থানীয় লোকজন আহত মনুকে উদ্ধার করে সদর হাসপাতালে ভর্তি করান। তার চারদিন পর মনু চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তার স্ত্রী, এক ছলে ও দুই মেয়ে রয়েছে।

কিশোর গ্যাংয়ের হামলা ও নির্যাতনের ভয়ে  কোন প্রতিবাদ ও মামলা করতে পারছিনা। বাড়ীঘর ছেড়ে দুই ছেলে ও মেয়ে নিয়ে পালিয়ে আত্বীয়ের বাড়ীতে আশ্রয় নিয়েছি বলে কেঁদে কেঁদে মোবাইলে জানান নিহতের স্ত্রী গৃহবধু শিল্পি রানী শীল।

তাদের প্রতিবেশি ও স্বজনরাও এঘটনায় যারা জড়িত তাদের আটক ও বিচার দাবি করেছেন।

স্থানীয় সচেতন গ্রামবাসীরা বলেছেন পুলিশ কিশোর গ্যাং ও তাদের মদদদাতাদের গ্রেফতারে অভিযান শুরু করলে গ্রামে ও শহরে কিছুটা কমবে কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সূত্র জানায়,  ছিনতাই বা আক্রমনের কবলে পড়েছেন এমন কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, যারা কিশোরগ্যাং রয়েছে তাদের বেশিরভাগের বয়স ১৪ থেকে ২২ এর মধ্যে।

সন্ধ্যার পর উদমারা এলাকার রাজুগো,তেলিবাড়ী, অধিকারী বাড়ির সুপারি বাগান, মানুর পানের বরজ, বেরিবাঁধসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় মাদক বেচাকেনা, মোটরসাইকেল ও সাইকেল ছিনতাইসহ মানুষকে আক্রমন করছে তারা।

প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, জেলার পুলিশ সুপার নির্দেশনা দিয়েছেন কিশোর অপরাধী ও তাদের মদদদাতাদের তালিকা তৈরি করতে। এছাড় বিট কর্মকর্তাদের তাদের বিটের নির্ধারিত এলাকায় কিশোর গ্যাং ও তাদের মদদদাতাদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে বলা হয়েছে।

থানা এলাকায় কারা কিশোর গ্যাং কালচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, কিশোরদের মধ্যে কারা মাদক বিক্রি, মাদক পাচার ও ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত তাদেরও তালিকা করতে বলা হয়েছে।

রায়পুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নিজাম উদ্দিন ভুইয়া বলেন, উদমারা গ্রামে মারামারি ঘটনায় আহতদের পরিবারকে সহযোগিতা দিয়েছে। তাদেরকে মামলা করতে বলা হয়ে ছিলো। তারা থানায় না করে আদালতে মামলা করেছেন। আসামিদের গ্রেপ্তার চেষ্টা চলছে।

জুয়া খেলার অপরাধে পিটিয়ে আহত এবং হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নাপিত মনু মারা যাওয়া ও পরিবার নিরুদ্দেশ এ ঘটনাও তো কেউ জানাননি।

কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। জেলায় অপরাধ পর্যালোচনা সভা হয়েছে।

ওখানেও কিশোর গ্যাংয়ের ব্যাপারে আলোচনা হয়। কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে সবাইকে একতা বদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।