বুধবার , ১৮ই জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ || ৪ঠা আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
তাবারক হোসেন আজাদ, লক্ষ্মীপুর:
গত ৫ আগষ্ট শেখ হাসিনার পতনের পর নয় মাস লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে মেঘনা নদীর বুকে জেগে ওঠা দুর্গম চরের জমি স্থানীয় প্রভাবশালীদের দখলে ছিলো।
মেঘনার ভাঙনের শিকার ভিটামাটি হারানো হাজারও মানুষ একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছিলো দুর্গম চরাঞ্চলে। অবশেষে নয় মাস পর শতাধিক জমির মালিক তাদের ১২’শ একর আবাদি জমিতে বুধবার দুপুরে ধান চাষ শুরু করেছেন।
বুধবার (২৮মে) সকাল নয়টায় উপজেলার দক্ষিন চরবংশী ইউপির মেঘনার চরের বায়রাঘাট এলাকায় কানিবগারচর জামে মসজিদে দোয়ার আয়োজন করা হয়।
এসময় রায়পুরের চরআবাবিল ইউপির হায়দরগন্জের প্রখ্যাত আলেম মুফতি স্যাইয়েদ তাহের জাবেরি আল মাদানির নেতৃত্বে ও দোয়ার অনুষ্ঠানে শাহিদা বেগম, সেলিম গাজি, অদুদ খান, আনোয়ার হোসেন হাওলাদার, মোঃ আবদুল কুদ্দুস, সুমন হাওলাদার, মোস্তফা বেপারি, মোহাম্মদ আলী মোল্লা, জাকির হোসেন হাওলাদার, মোঃ লিটন ও কামালসহ শতাধিক জমির মালিক উপস্থিত ছিলেন।
কৃষক লিটন হোসেন ও আনোয়ার হোসেন জানান, ২০২৪ সালের নভেম্বরে উত্তর ও দক্ষিন চরবংশী ইউপির মেঘনার চরে গত ১৭ বছর সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আ’লীগ নেতা আলতাফ মাস্টারসহ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতাদের দখলে ছিলো চরের প্রায় ৬ হাজার সরকারি খাস জমি। এসব জমি উদ্ধার প্রকৃত মালিকরা অনেক চেষ্টা করলেও দেওয়া হয়নি।
গত ২০ ও ২১ ডিসেম্বর রায়পুরের মেঘনার চর, মাছঘাট ও বাজার দখলকে কেন্দ্র করে তিন দফায় উপজেলা সেচ্ছাসেবক দলের সদস্য সচিব শামিম গাজিসহ তার অনুসারী এবং উত্তর চরবংশী ইউপির বিএনপির সহসভাপতি ফারুক গাজীসহ তার অনুসারীদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে দলীয় কার্যালয়, মাছের আড়ত, বসতঘর, দোকানপাট ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়। একইসঙ্গে দুটি মোটরসাইকেল অগ্নিসংযোগ করা হয়।
এ ঘটনায় ২২ ডিসেম্বর রায়পুরের সাবেক এমপি আবুল খায়ের ভূঁইয়ার নির্দেশে উপজেলা বিএনপির নেতৃবৃন্দু সংবাদ সম্মেলন করে উত্তর চরবংশী ইউপির বিএনপিসহ সহযোগী সংগঠনের সকল কমিটি বিলুপ্ত করেছেন।
গত ৭ এপ্রিল আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে উত্তর চরবংশী ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি ফারুক কবিরাজ ও উপজেলা কৃষকদলের সদস্য সচিব শামীম গাজী গ্রুপের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ সাইজ উদ্দিন নামে এক বিএনপি কর্মী প্রাণ হারান। তার ৭দিন পর আহত স্বেচ্ছাসেবকদলের নেতা জসিম উদ্দিন ব্যাপারী ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
ঘটনার তিনদিন পর নিহত সাইজ উদ্দিনের ভাই হানিফ দেওয়ান বাদী হয়ে বিএনপি নেতা ফারুক কবিররাজকে প্রধান করে ২৬ জনের নাম উল্লেখ ও ১৮৬ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে হত্যা মামলা করেন।
উল্লেখ্য, রায়পুরের উত্তর চরবংশী, দক্ষিণ চরবংশী ও উত্তর চরআবাবিল ইউপির মেঘনার চরাঞ্চলের এসব জমিতে ভূমিহীনদের সরকারিভাবে বন্দোবস্ত দেওয়ার কথা থাকলেও পুনর্বাসনের নামে একশ্রেণির অসাধু ভূমি কর্মকর্তার যোগসাজশে ওই ভূমি চলে যাচ্ছে প্রভাবশালীদের দখলে।এই জমি উদ্ধারে জমির মালিকরা বিক্ষোভ, সভা-সবাবেশ, থানা, সেনা ক্যাম্প, ইউএনও, সহকারি কমিশনার ভূমি ওআদালতে আবেদন ও মামলা করেছিল।
দক্ষিন চরবংশী ইউপি চেয়ারম্যান আবু সালেহ মিন্টু ফরাজি ও উত্তর চরআবাবিল ইউপি চেয়ারম্যান আবু জাফর দুলাল হাওলাদার সত্যতা শিকার করে বলেন, আগে দখলে ছিল আ’লীগের কয়েক নেতা।
৫ আগষ্টের পর গত নয় মাস ধরে চরের বিএনপি নেতাদের দখলে। এখন কিছু অংশ জমি প্রকৃত জমির মালিকরা দখলে নিয়ে চাষ শুরু করেছেন বলে জেনেছি।
রায়পুর উপজেলা পরিষদের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আলতাফ মাস্টারসহ তার অনুসারী সাবেক মেম্বার মফিজ খান, আবুল মাল ও ফারুক ছৈয়ালসহ কয়েকজন অনুগত চরঘাসিয়া, চরকানিবগা ও চরকাচিয়ায় কয়েকশ একর খাস জমি বছরের পর বছর দখল করে রেখেছিলেন। কোনো ভূমিহীন লোক এসব বিষয়ে প্রতিবাদ করতে পারেননি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ৮ জন কৃষক জানান, গত ১৭ বছর সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আলতাফ মাস্টারের দখলে ছিল চরের বিশাল খাস জমি। শেখ হাসিনার পতনের পর গত নয় মাস ধরে ৩০-৫০ জনের দলবদ্ধ স্থানীয় প্রভাবশালী চর দখলে নিতে মরিয়া হয়ে উঠে।
উত্তর চরবংশী ইউনিয়ন সহকারী ভূমি কর্মকর্তা মো. মামুন জানান, মেঘনার বুকে জেগে ওঠা সরকারি খাস জমি এতোদিন আ’লীগ নেতাদের দখলে ছিলো। বর্তমানে এসব চরে প্রায় ৬ হাজার ৭০০ একর সরকারি খাস সম্পত্তি দখল করে রেখেছে প্রভাবশালীরা।
রায়পুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন জানান, চরাঞ্চলের কয়েকশ’ একর সম্পত্তি নিয়ে আদালতে মামলা চলছে। আমার সম্পত্তি এতদিন আমার দখলেই ছিল। সরকার পতনের পর উত্তর ও দক্ষিণ চরবংশী ইউপির বিএনপির নেতারা চরগুলো দখলে নিয়ে যায়।
উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক নাজমুল ইসলাম মিঠু ও সদস্য সচিব শফিকুর রহমান ভুঁইয়া বলেন, মেঘনার নদীর পাড়ে জেগে ওঠা হাজার হাজার একর চরের জমি যাদের দলিল আছে, তারাই ভোগ দখল করবেন। বিএনপি ও সহযোগি সংগঠনের কোন নেতাকর্মী অন্যায়ভাবে জড়িত থাকলেই দলীয়ভাবে ব্যাবস্থা নেতা হচ্ছে।
আধিপত্ত্ব বিস্তারকে কেন্দ্র করে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে মারামারির ঘটনায় ওই ইউনিয়নের বিএনপিসহ সহযোগী সংগঠনের সকল কমিটি বিলুপ্ত করা হয়।
লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক রাজিব কুমার সরকার জানান, শুধুই রায়পুরের মেঘনার বুকে জেগে ওঠা চর নয়, চারটি উপজেলার আওতাধীন চরগুলো প্রভাবশালীদের দখলে রয়েছে এমন অভিযোগের ভিত্তিতে চরগুলোতে পরিদর্শনে যাব।
চরাঞ্চলে সরকারের যে খাস সম্পত্তি কোন ব্যাক্তি অনুমতি ছাড়া ভোগ দখল করতে পারবেন না। করলেই আইনি ব্যবস্থা।