সুন্দরগঞ্জে স্কুলছাত্রী অপহরণের
২১ দিন পরও হয়নি উদ্ধার
আবু বক্কর সিদ্দিক, গাইবান্ধাঃ
গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে পরিকল্পিতভাবে অপহরণের শিকার স্কুলছাত্রী ২১ দিনেও উদ্ধার হয়নি। এ ঘটনায় নানাভাবে জড়িত সংঘবদ্ধ চক্রের সকলেই আজও রয়েছে অধরা।
জানা যায়, গত ১৬ ফেব্রুয়ারী সন্ধ্যা সাড়ে ৬ টায় উপজেলার শোভাগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের ৯ম শ্রেণীর এক ছাত্রী স্থানীয় ডিগ্রী কলেজ মোড় থেকে পূর্ব-পরিকল্পিতভাবে অপহরণের শিকার হয়।
এসময় একই স্কুলের ছাত্রী ও অপহৃতার প্রতিবেশী রঞ্জিনা আক্তার (আর্জিনা) তার মোবাইলফোনে মিনিটকার্ড রিচার্জের কথা বলে ফাঁকি দিয়ে ঐ স্কুলছাত্রীকে ডেকে আনে।
রঞ্জিনার ছোট ভাই কামরুজ্জামানসহ ৩ জনই উক্ত কলেজ মোড়স্থ মিনি-বিশ্বরোডে উঠলে অপহরণকারী চক্রের সদস্যরা জোড়পূর্বক ঐ স্কুলছাত্রীকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়।
ঘটনার পর রঞ্জিনা প্রথমে অস্বীকার করার চেষ্টা করলে তার ছোট ভাই কামরুজ্জামান স্থানীয়দের কাছে ঘটনা বলে দেয়। কিন্তু, কোন নাম বলতে পারেনি।পরে রঞ্জিনা একেক বার একেক নাম ও ঠিকানা বলে।
বিষয়টি স্থানীয়রা জানার চেষ্টায় রঞ্জিনাকে প্রশ্ন করতে থাকে।
এছাড়া, রঞ্জিনার মোবাইলফোন ও ২টি সীমকার্ড যাচাই করলে তার সঙ্গে অপহরণকারী চক্রের গোপন সখ্যতা ও যোগসূত্রের তথ্যচিত্র সংগ্রহ করতে সক্ষম হন।
এ ঘটনায় রঞ্জিনাসহ অপহৃতার বাবার পরিবারের সঙ্গে জমি নিয়ে বিরোধীয় পক্ষেরও যোগসূত্রের প্রমাণ বেরিয়ে আসতে থাকে।
অপহরণকারীদের অধিকাংশই পার্শ্ববর্তী শ্রীপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ সমস গ্রামের বাসিন্দা।
এদের মধ্যে আব্দুল ওরফে আঃ রহিমের ছেলে মমিন মিয়া (১৮), মোস্তফা মিয়ার ছেলে ফারুক মিয়া (১৮), আলমগীর হোসেনের ছেলে মাহিদ ইসলাম (১৭), আঃ মতিনের ছেলে জাহাঙ্গীর আলম (৩৮), আঃ রহিম ওরফে আব্দুলের ছেলে আব্দুল মোত্তালেব (১৭), মোহাম্মদ আলীর ছেলে সফিউল ইসলাম (৪০) ও স্বাধীন মিয়াসহ অজ্ঞাতনামা আরো ৪-৫ জন।
রঞ্জিনার কথামতো অপহরণকারী চক্রটি অপহৃতার বাবার পরিবারকে প্রতারণা, হুমকীসহ অনৈতিক দাবী করছে।
অপহৃতার পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, ঘটনার আগে থেকেই অপহৃতা বাড়ির নিজের শয়নঘরে পড়তে বসেছিল। তার মা রান্নার কাজ করছিল।
এসময় ছোট ভাই কামরুজ্জামানকে সঙ্গে নিয়ে রঞ্জিনা তার মোবাইলফোনে মিনিটকার্ড রিচার্জের কথা বলে ঐ স্কুলছাত্রীকে ডেকে নিয়ে যায়।রঞ্জিনাসহ অপহরণকারী চক্রকে সহযোগিতায় ছিল অপহৃতার বাবার পরিবারের সঙ্গে জমি নিয়ে বিরোধীয় পক্ষের আরো এক নারী ও তার মেয়ে।
গত ৮ মার্চ থেকে ঘটনার ২১ দিন পেরিয়ে গেলেও ১৩ বছর বয়সী অপহৃতা ঐ স্কুলছাত্রী উদ্ধার হয়নি। এমনকি, জড়িতদের কেউই গ্রেপ্তার হয়নি। সকলেই রয়েছে অধরা। এ ঘটনার ২দিন পর (১৮ ফেব্রুয়ারী) অপহৃতাকে ফেরৎ দেয়ার কথা বলে শ্রীপুর ইউনিয়ন কাজী আব্দুল মান্নান তার বড়ুয়াবাজারস্থ কাজী অফিসে ইউপি’র সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম রাজা’র সভাপতিত্বে সালিশের নামে অপহৃতার পরিবারের কাছ থেকে বিভিন্ন কাগজে সহি-স্বাক্ষর গ্রহণের পর একটি রহস্যজনক সালিশ ও অঙ্গীকারনামা প্রস্তুত করেন।
এরপর অপহৃতাকে সালিশস্থলে আনার জন্য কাজী আব্দুল মান্নান, তার ছেলে সামিউল ইসলাম ওরফে সোহেল, আব্দুল হক ওরফে আঃ রহিম মোটরসাইকেল নিয়ে চলে যান কাজীর ভগ্নিপতি জেলা সদরের মালিবাড়ি ইউনিয়নের কচুয়ার খামার গ্রামের মৃত আঃ রহিমের ছেলে রফিকুল ইসলামের বাড়ি। তারা ৩ জনই অপহৃতাকে জেলা শহরে রেখে গভীর রাতে একাকী ফিরে এসে কাজী আঃ মান্নান অপেক্ষমান অপহৃতার পরিবারবর্গকে মিথ্যা কথা বলে কিছু ব্যক্তির নামে মামলা করার কথা বলেন। সে সব ব্যক্তির মধ্যে একমাত্র তার ভাই আব্দুল ওরফে আব্দুর রহিম ছাড়া অন্যান্যরা সকলেই কাজীর মেয়ে নিয়ে চলমান মামলার প্রতিপক্ষ। এখানেই থেমে যায়নি ছেলে সোহেল, ভাই আব্দুলসহ কাজী আঃ মান্নানের কেরামতি।
তারা অপহৃতাকে বিভিন্ন স্থানে লুকিয়ে রাখা, কথিত মানবাধিকারকর্মী ও গণমাধ্যমকর্মীকে ডেকে ১৩ বছর বয়সী ঐ অপহৃতাকে নানাভাবে বাধ্য করে বক্তব্যের ভিডিওসহ স্থিরচিত্র ধারণ, বিভিন্ন কাগজে সহি-স্বাক্ষর গ্রহণ করা অব্যাহত রেখেছেন বলে বিভিন্ন মাধ্যমে অপহৃতার পরিবারকে অবগত করাচ্ছেন।
এছাড়া, এ ঘটনায় মামলা হয়েছে ভেবে অপহৃতার বাবাকে কাজী, তার ছেলে ও কাজীর ভাই আব্দুল বিভিন্ন সময় নানান ব্যক্তিকে দিয়ে মোবাইলফোনে মেয়ে ফিরিয়ে দেয়ার প্রস্তাব দিয়ে মুক্তিপণ দাবী করছেন।
এমনকি, হুমকীও অব্যাহত রেখেছেন। অপহৃতা ঐ স্কুলছাত্রী তার বাবা-মায়ের কাছে ফিরে গিয়ে স্কুলে লেখা-পড়া করার কথা বলায় কাজী আঃ মান্নান, তার ছেলে সোহেলসহ অপহরণকারীরা অপহৃতাকে শারিরীক ও মানসিকসহ নানাভাবে নির্যাতনের কথা অপহৃতার পরিবারকে বিভিন্ন মাধ্যমে অবগত করাচ্ছেন।
এরই একপর্যায়ে গত ২০ ফেব্রুয়ারী বেলা ১১টা ২৫ মিনিটে মোবাইল নম্বর থেকে অপহৃতার বাবার ফোনে কল করে এক নারী কলার নিজেকে একটি মানবাধিকার সংস্থার গাইবান্ধা জেলার সেক্রেটারী পরিচয় দিয়ে বলেন, ‘আপনার মেয়েকে ফেরৎ চান যদি খরচা-পাতি নিয়ে আমার অফিসে আসেন। তার আগে আপনাকে মামলা তুলে নিতে হবে। না হলে মেয়ে তো পাবেন না বরং আপনিই উল্টো মামলায় জেল খাটবেন। এ ধরণের অনেক কাজ করেছি।
আমাকে ডিসি, এসপি, সবগুলো থানার ওসি ভাল করেই চেনে’। ৩ মিনিট ৩৪ সে. ধরে তার শর্তারোপকৃত কথা ও হুমকী চলতে থাকে। এরপর কয়েকদফা কথার মাঝে একবার পরিবহণের খরচের হিসেব দিয়ে তার নিজের জন্য কী…! রাতে মোবাইলফোনে মেয়েকে ফেরৎ চেয়ে অপহৃতার বাবা কল করলে তিনি জানান- ‘ আপনি আর মেয়েকে পাবেননা, যখন বলেছি-তখন আমি মেয়ের সামনে ছিলাম, আপনার মেয়ে তো ছোট, এখন কি করবেন- বিয়ে দিয়ে মেনে নিবেন, আপনার মেয়ে অসুস্থ্য, তার পায়ে কোন জুতাও নেই, মেয়ে আপনার কাছে না যেতে পারলে সে না-কি বিষ খাইবে, তো এখন কি করবেন।
মেয়েকে নিবেন তো’! কয়েকদফা কথায় মেয়েকে ফেরৎ দেয়ার এখতিয়ার রাখলেও রাতে তিনি (ঐ নারী কলার) ব্যর্থতা স্বীকার করেছেন।
উক্ত ইউপি’র সাবেক চেয়ারম্যান ও কথিত সালিশের সভাপতি নজরুল ইসলাম রাজা বলেন– সালিশনামা ও অঙ্গিকারনামাসহ যেসব ঘটনা ঘটেছে। তা কাজী আঃ মান্নান, তার ছেলে সামিউল ইসলাম ওরফে সোহেল, কাজীর ভাই আব্দুল ও সাবেক মেম্বর আঃ হামিদ সরকারের পরিকল্পনা মাফিক। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন- এতে অপহৃতার পরিবারকে চরমভাবে হেয়প্রতিপন্ন ও প্রতারণা করা হয়েছে। কাজী আঃ মান্নান পক্ষ ঘটনা থেকে ঘটনাবহুল যা করেছে-সবই অপহৃতাসহ তার পরিবারের জন্য চরমভাবে মানবাধিকার লংঘনজনক।
তিনি আরো বলেন, সভাপতির আসনে থাকলেও ঐ সালিশনামা ও অঙ্গিকারনামা লেখা শেষে তিনি স্বাক্ষর করেননি।
Post Views: ৪১