শুক্রবার , ১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ || ৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মোল্লা তানিয়া ইসলাম তমাঃ

প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি । দেশে অর্থনীতি, ব্যবসা বাণিজ্য বড় হচ্ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে সংবাদপত্র এবং টেলিভিশনসহ অনলাইনের সংখ্যা। তবে সাংবাদিকতার মান কতটুকু বেড়েছে? এর সঠিক ব্যাখা আমার জানা নেই । তবে বর্তমানে সাংবাদিকদের সংগঠন ও সাংবাদিক বাড়ছে অস্বাভাবিক হারে ।

দুই একটি ছাড়া এসব সংগঠন কেন হচ্ছে? কারা করছে? কাদের স্বার্থরক্ষা করছে? সেটা আপনারা ভাল ভাবেই অবগত । বর্তমানে অনেকে সাংবাদিকদের এসব সংগঠনকে নিয়ে ব্যাঙ্গ করে । কয়েকজন সাংবাদিক একসঙ্গে মিলে খুলে ফেলছে একেকটি সংগঠন । তারপর এই সব সংগঠনে উৎপাদিত সাংবাদিকদের করতে হবে পিকনিক বা জমকালো কোন অনুষ্ঠান । অনুষ্ঠান করতে এবং খাওয়া-দাওয়া, পুরস্কার দিতে অনেক টাকা লাগবে । সহজ পদ্ধতি, নেমে পড়বে চাঁদাবাজিতে । আর এ জন্যই অনেকে মজা করে বলেন, সংগঠনের সাংবাদিক উৎপাদিত সাংবাদিক । মজার ব্যাপার হচ্ছে এসব সংগঠনের সকল সদস্যদের কমন স্লোগান ‘আমাদের প্রাণের সংগঠন’। অর্থাৎ ডিআরইউ, জাতীয় প্রেসক্লাব থেকে শুরু করে প্রকৃত সাংবাদিকদের সব সংগঠণের শ্লোগান হচ্ছে প্রাণের সংগঠন । আবার এসব সংগঠন করতে গিয়ে ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে মিল না হলেই আবার আর একটি ‍নতুন সংগঠনের জন্ম দেয়া হবে ।

তারপর আরেকদল হলো নির্বাচনী সম্প্রদায় । অর্থাৎ ক্যারিয়ার নয় বিভিন্ন সংগঠনের নির্বাচন করে বেড়ানোই যেন তাদের একমাত্র ও অন্যতম কর্তব্য । আবার এইসব সংগঠনের কোন কোন সাংবাদিক এলাকার কোন এক জনহিতৈষী ব্যক্তির বিরুদ্ধে মনগড়া কুরুচি সম্পূর্ণ শব্দ ব্যবহার করে মিথ্যা বানোয়াট সংবাদ প্রচার করে থাকে নাম সর্বস্ব কোন একটি সংবাদ মাধ্যমে । আবার অন্য একটি সংগঠনের কোন কোন সাংবাদিক ঐ জনহিতৈষী ব্যক্তির গুণগান গেয়ে অন্য কোন একটি নাম সর্বস্ব সংবাদ মাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ করে । এর মানেটা কি দাঁড়ালো? বর্তমানে দেশে অনলাইন ভিত্তিক সংবাদ মাধ্যমে ছেয়ে গেছে আর হাতে গোনা কয়েকটি অনলাইন ভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম সরকারের নীতিমালা অনুসরণ করে চললেও শত শত অনলাইন ভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম সরকারের কোন নীতিমালার তোয়াক্কা করেনা । আর এই সব সংবাদ মাধ্যম ২০০/১০০০ টাকার বিনিময়ে রিক্সা চালক, চা দোকানদার, ফ্লেক্সিলোডের দোকানদার, ছিনতাইকারী, চোর- ডাকাত, মাদক ব্যবসায়ী, নিজের নামটি পর্যন্ত লিখতে পারেনা এই সব মানুষদের গলায় ঝুলিয়ে দেয় প্রেস কার্ড আর বানিয়ে ফেলেন সাংবাদিক । আর এইসব সাংবাদিকরাই মোড়ে মোড়ে একটি দোকান ঘর ভাড়া নিয়ে অথবা রাস্তার পাশে সরকারী জায়গায় একটি ঘর তুলে বানিয়ে ফেলেন নামে বেনামে সাংবাদিক সংগঠন । বর্তমানে এলাকা ভিত্তিক কোন সরকারী বে সরকারী প্রতিষ্ঠানে কোন সাংবাদিক কোন কাজে গেলে তাকে প্রশ্ন করা হয় আপনি কোন ক্লাব বা কোন সংগঠনের সাংবাদিক । কিন্তু তাকে জিজ্ঞেস করা হয়না আপনি কোন সংবাদ মাধ্যমে কর্মরত । তাই অনেকে মনে করেন এই সব সংগঠনের বাইরে যারা আছেন তারা কোন সাংবাদিকই নয় । এমন পরিস্থিতে প্রকৃত সাংবাদিকরা বর্তমানে নিজেদের সাংবাদিক হিসেবে পরিচয় দিতেও সংকোচ মনে করেন । এখন সময় এসেছে ভাবার । ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে ওঠা এসব সাংবাদিক বা সংগঠন কী পেশাদার সাংবাদিকদের মর্যাদা বাড়ায়, নাকি মর্যাদা হারায়?

এ কথা এখন পরিস্কার, একশ্রেণীর সাংবাদিক বিভিন্ন উপলক্ষে বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে চাঁদাবাজী করছে। এসব অনেক নেতা বা প্রভাবশালী সাংবাদিকদের এখন ঢাকায় বাড়ী, গাড়ীসহ অনেক সম্পদ। অপরদিকে দীর্ঘ সময় ওয়েজবোর্ডের আওতায় চাকুরি করেও বেশিরভাগ সাংবাদিকই তেমন কোন কিছুই করতে পারেনি।
সিনিয়র সাংবাদিক নেতাদের ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে ওঠা এসব সংগঠন নিয়ে সচেতন হওয়া প্রয়োজন । তাদের ভাবতে হবে একজন পেশাজীবী সাংবাদিক হিসেবে পরিচয় দিতে কি কি যোগ্যতা থাকা প্রয়োজন? কেবল কোন সংবাদ মাধ্যমে কাজ করলেই কি সে সাংবাদিক হিসেবে পরিচয় দিবে? সাংবাদিকতা পেশায় যারা আসেন তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা কি হওয়া প্রয়োজন? আমরা জানি- প্রথম শ্রেণীর ২০/৩০টি বাংলা ও ইংরেজী সংবাদপত্র, কয়েকটি টেলিভিশন, তাদের প্রতিষ্ঠানে স্টাফ রিপোর্টার/সাব এডিটর হিসেবে ঢাকায় কাজ করতে আজকাল শিক্ষাগত যোগ্যতা চাওয়া হচ্ছে । কিন্তু এখনো বেশিরভাগ সংবাদ মাধ্যমে স্টাফ রিপোর্টার বা সাব এডিটর হিসেবে কাজ করতে কোন মিনিমায়ম যোগ্যতা প্রয়োজন হয় না। টেলিভিশনে তো বুম ধরতে পারলেই হলো । আর অনলাইনে কাট পেস্টই যথেষ্ট। অর্থাৎ কম্পিউটার জানলেই হয়ে যায় ।

বর্তমানে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, যে কোন ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা একটি টেলিভিশন চ্যানেল, একটি অনলাইন খুলে যে কোন যোগ্যতার একজনকে বিভিন্ন পদে বসিয়ে দিতে পারেন। তার যোগ্যতা লেখাপড়া বা অভিজ্ঞতার চেয়েও বড় দরকার তার আনুগত্য। প্রয়োজনীয় যোগ্যতা না থাকলেও সে সাংবাদিক হয়ে গেলো। কিন্তু অন্যান্য পেশাজীবী সংগঠনে এটা সম্ভব না। যেমন কেউ যদি আইনজীবী হন তাহলে আইন পেশায় কাজ করতে বার কাউন্সিলে পরীক্ষা দিয়ে পাস করে প্র্যাকটিস করতে হবে । আবার কেউ যদি ডাক্তার হন তবে তাকে একটি পেশাজীবী সার্টিফিকেশন নেয়ার ফলে নিজেকে সমাজে ডাক্তার পরিচয় দিতে পারবে। ইঞ্জিনিয়ার হলে আইইবি’এর সনদ পেলে সমাজে ইঞ্জিনিয়ার পরিচয় দিতে পারবে বা নামের পাশে ইঞ্জিনিয়ার টাইটেল ব্যবহার করতে পারবেন।

বাংলাদেশে একমাত্র সাংবাদিকতা পেশায় সাংবাদিক পরিচয় দিতে বা নামের আগে সাংবাদিক লিখতে কোন সার্টিফিকেশন বা সনদ প্রয়োজন হয় না। এর ফলে যে কোন মানের লোকজন এ পেশায় আসছে। আবার সাংবাদিক না হয়েও কখনো সাংবাদিকতা না করেও এখন অনেকে সাংবাদিক নেতা। অর্থের দাপটে, ক্ষমতার দাপটে তারা বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা ভোগ করছে। যেখানে পেশাদার সাংবাদিক বঞ্চিত হচ্ছে। স্বাধীনতার পরপরই অনেক চিহ্নিত রাজাকার সাংবাদিকতা পেশায় এসে সম্পাদক হয়েছে, আবার রাজনীতিও করেছে। এখনো বর্তমান প্রজন্মের অনেক সাংবাদিক যারা জামায়াত শিবির রাজনীতির সাথে সরাসরী সম্পর্ক আছে, তারা পরিচয় গোপন করে অনেক ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সেজে সাংবাদিকতা করছে। সাংবাদিকতায় সার্টিফিকেশন ব্যবস্থা নেই বলে এটা সম্ভব হচ্ছে।

মফস্বল সাংবাদিকদের দিকে তাকালে আরো বেহাল অবস্থা। মফস্বল সাংবাদিকতার প্রয়োজনীয়তা বা গুরুত্ব বাড়ালেও সেখানকার ভালোমন্দ বা নীতি আদর্শ দেখার কেউ নেই। যার ফলে চলছে যে যার মত। বেশিরভাগ সংবাদপত্র বা টেলিভিশন বিভাগীয় শহর ছাড়া বেতন ভাতা দেন না। অধিকাংশ জেলা শহরগুলোতে সাংবাদিকদের কোন বেতন দেওয়া হয় না। কিন্তু সাংবাদিকরা নিজেদের মত করে এ পেশাটাকে একটা মহান চাঁদাবাজী পেশায় রপান্তরিত করেছে।

সময় এসেছে এসবের পরিবর্তনের। সাংবাদিকতা পেশায় সাংবাদিক কারা তা চিহ্নিত করা হোক। এটাকে একটি অন্যান্য বিশেষায়িত পেশার মত সনদ ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হোক। যারা কোন দিন ওয়েজবোর্ডের আওতায় বেতন পাননি বা সাংবাদিকতা করে জীবিকা নির্বাহ করেননি, এমন সাংবাদিকদের নেতা বানানো বন্ধ হোক। নেতা হওয়ার স্বার্থে তথাকথিত আন্ডারগ্রাউন্ড সাংবাদিকদের আর পুশবেন কিনা তা ঠিক করুন। তা না হলে সাংবাদিকদের সামনে আরো কঠিন বিপদ অপক্ষো করছে বলে আমি মনে করি ।